রাত তিনটে... ভোর তিনটে
মশাটা কতক্ষণ বসে আছে জানি না। কতটা রক্ত খেয়েছে টের পেলাম, মেরে
ফেলার পর। ফুলে ঢোল হয়ে গেছিল, আলতো মারেই ফেটে শেষ হয়ে গেল।
ওড়ার জন্য যতটা হুঁশ থাকা দরকার, ততটাও বোধহয় ছিল না। যদি
থাকত, তাহ’লে অবহেলায় আসা এক উদাসীন
আঘাৎ... সে কি এমন মারন হয়ে উঠতে পারে? রক্তেরও বোধহয় নেশা
হয়, নেশায় বুঁদ ছিল... সেই ঘোরেই চলে গেল। কতটা রক্ত খেয়েছে,
বুঝলাম চামড়ার ওপর ছড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে। আমার কাঁধের নিচে, আমারই চামড়া ওপর ছড়িয়ে পড়া রক্ত। এতক্ষণ বসেছিল, কতক্ষণ
বসে ছিল কে জানে! তাও, কিছুতেই নিশ্চিৎ চিনতে পারলাম না...
সবটা আমার রক্ত কি না। মৃত্যু এবং রক্তপাত। অথচ সে রক্ত তার নয়, রক্তের সবটা আমারও নয়। আর আমার হলেও কিছু করার নেই। ছোটবেলা একবার এভাবেই
চাপড় দিয়ে একটা টসটসে মশাকে ফাটিয়ে দেওয়ার পর অনেকটা রক্ত দেখে মাকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘আচ্ছা, আমারই
রক্ত... চেটে খেয়ে নিলে আবার ভেতরে চলে যাবে?’ মা একদম তেতে
উঠে বললেন বললেন – ‘একটা চড় লাগাব! বিষ!... বিছানায় পড়ে
থাকতে হবে। শিগগির হাত ধো গিয়ে!” তারপর আমি বললাম, মা বলল, আমি বললাম, মা বলল...
যুগোপযোগী সাহিত্য নয়, তাই কারও ভাল লাগবে না সে সব। শুধু
বুঝলাম, আমারই রক্ত... কিন্তু এখন বিষ। ‘শিগগির হাত ধুয়ে ফেলতে হয়’। আজও হাত ধুয়ে নেবো, এভাবে
রক্ত শুকিয়ে যাওয়া ভাল নয়... বিষ, শুকিয়ে গেলেও বিষই থাকে।
তারক ওর
মুর্গীর দোকানটা বন্ধ করার আগে ভাল করে ধুয়ে নেয়, যাতে সব
রক্ত ধুয়ে যায়। আগের দিনের রক্ত পরের দিন কখনও শুকিয়ে থাকে না দোকানের সামনে...
কিংবা ভেতরে কোথাও। তিলুকাকার দোকানের সামনে মস্তানগুলো চাকু দিয়ে যাকে ফাঁসিয়ে
গেছিল, তাকে পাড়ার কেউ চিনতে পারে নি। আমিও পারিনি। রাস্তার
ওপর রক্তের দাগ অনেক ক্ষণ পড়েছিল, শুকিয়ে গেছিল। একটা
কনস্টেবলকে ফিসফিস করে বলেছিলাম ‘রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে... বিষ।
ধুয়ে দিতে বলব?’ লোকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল ‘কি হয়েছে?!’। এতো জোরে বলল, যে
আমি দু’পা পিছিয়ে গেলাম। না, তারপর আমি
আর কিছু বলিনি, কিন্তু সে আরও কিছু বলছিল... হয়ত আমাকেই।
বিশ্বাস করুন, আর কি বলেছিল সেসব মনে নেই। এমন লোকটাকে কেমন
দেখতে চেয়েছিল তাও মনে নেই। আসলে যেভাবে, খুন হওয়া লাশটাকে
চিনতে পারিনি, তেমন খাকি উর্দিদেরও আর দেখলে চিনতে পারব না।
ভিড় থেকে সরে এসেছিলাম। দেখলাম, তিলুকাকা দোকানের সিঁড়ির
পাশে নর্দমাটার সামনে ঝুঁকে পড়ে কমলা রঙের প্লাস্টিকের জগ থেকে জল ঢেলে কচলে কচলে
হাত ধুচ্ছে। আমিও হাত দু’টো বাড়িয়ে দিলাম, বললাম ‘আমাকেও একটু ঢেলে দাও’। তিলুকাকা চোখ তুলে শুধু বলল,
‘ভালই করেছিস সরে এসেছিস।’ আসলে, কি বলতে কি বলে ফেলব বুঝতে পারি না। তাই চুপ করে থাকি। আর চুপ করে থাকতে
থাকতে পা দু’টো নিজে থেকেই একটু একটু করে সরে আসে, পিছিয়ে আসে। যেখানে কিছু বলার নেই, শোনার নেই...
সেখানে থাকারও নেই। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, এমন হয়। এখন আর ভেবে চিন্তে কিছু করি না... নিজে থেকেই হয়। না... আমি
কখনওই বলছি না আমি পালিয়ে গেছি। আমার পা’গুলো আমাকে সেখান
থেকে সরিয়ে এনেছে, যেখানে আমার না থাকলেও চলবে।
সেদিন
লাশ নিয়ে যাওয়ার কতক্ষণ পর শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ধোয়া হয়েছিল, জানি
না। জজ সাহেবের সরকারী গাড়ি, ওনার মেয়েকে কলেজ থেকে নিয়ে
ফিরতে ফিরতে পাড়ার অতদিনের প্রতিবেশী বুড়ি বেড়ালটাকে যখন চাপা দিয়ে চলে গেল... তখন
কেন কেউ পুলিস ডাকেনি... তাও জানি না। তখন ছিলাম না ধারে কাছে কোথাও, পরে এসে যখন শুনেছিলাম, বললাম – “একটা থান ইট ছুড়লি না কেন? গাড়ির একটা কাঁচ তো ভাঙত!
তারপর অন্য কথা!” এসব পাগলামী কে কেউ সমর্থন করে? করে না... করেনি। তাই এ’কথা শুনে
কে কি বলল সেসব কথা থাক। সেদিন মাঝবয়সী লোকটার উপুর হয়ে পড়ে থাকা লাশ দেখে কষ্ট
হয়নি... অথচ বেড়ালটার কথা ভেবে গলার কাছে ব্যথা হচ্ছিল মাঝে মাঝে। তবে সে কষ্ট
আমার নিজের, তাই সেই কষ্টের কথাও থাক। আসলে কষ্ট পাওয়াটাও
একটা আলপিন পরীক্ষার মত, যেটা নানা জায়গায় বিঁধিয়ে
বিঁধিয়ে কেউ মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে সবটাই অসার হয়ে গেছে... নাকি এখনও কোথাও কোথাও
সার আছে। আমি হাসব, গান শুনব, টিভি
দেখব, মুড়ি-তেলেভাজা খাবো, দুর্গাপুজোয়
ঠাকুর দেখব মেয়ে-বউ নিয়ে... সবই থাকবে। কারণ আমার ভাল থাকতে ভাল লাগে, ভাল থাকতে ইচ্ছে হয়। অথচ, এই অসার হয়ে যাওয়ার মত
কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে, তাই এই আলপিন বিঁধিয়ে মাঝে মাঝে যেন
দেখে নিতেই হয়। না না... আমি নিজে বেঁধাই না মোটেই! কিন্তু কেউ একটা নিশ্চয়ই
বেঁধায়... আমি ঠিক জানিনা, বুঝি না। কিন্তু কেউ তো আছেই...
আমি যখন নই, কেউ তো আছেই... নিজে থেকে কি আলপিন বিঁধতে পারে,
বলুন? গলার কাছে জমে ওঠা যে ব্যথাটা?...
স্যার
আবার একটা অন্য কথা বলেছিলেন। আমি গুছিয়ে ‘সার’ বলতে পারি না। চেষ্টা করেও দেখেছি, অজান্তে বার বার ‘স্যার’ই বলে ফেলি। স্বাভাবিক ভাবে যেটা থাকে,
তার থেকে যাওয়াই ভাল। স্যার, মানে আশিষ
স্যারের কথা বলছিলাম। উনি বলতেন মনের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন কষ্ট থেকে যায়, যা ঠিক কেমন তা বোঝাই যায় না। ব্যথা হচ্ছে, কিন্তু
কোথায় ব্যথা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না... কেন হচ্ছে সেইটা ভাবতেই বেশি ইচ্ছে করে তখন।
ফিজিক্স ক্লাসে হঠাৎ এই কথাগুলো কেন বলেছিলেন, তা কোনও সূত্র
ধরে মেলানো মুশকিল। কোন এক কথা প্রসঙ্গে ওনার স্কুল জীবনের এক শিক্ষকের কথা মনে
পড়ে গেছিল... যিনি নিজে খুব ভাল গান গাইতে পারতেন। নিজের ফেয়ারওয়েলের দিন
গেয়েছিলেন ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধা’। আর
ওনার মৃত্যুশয্যায়, হাসপাতালে যখন ছাত্ররা ঘিরে ছিল... তখন
ওনার সব থেকে প্রিয় ছাত্র এই একই গান ওনাকে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। আশিষ স্যার এই
কথাগুলো আমাদের কি কোনও শিক্ষক দিবসে বলেছিলেন? মনে নেই।
এছাড়াও আরও অনেক কিছু বলেছিলেন... কি বলেছিলেন, তাও মনে নেই।
শুধু, সেদিনের আর একটা কথা মনে আছে – ‘আমরা
যে তোদের এত কথা বলি... এরকম হ’তে বলি, ওরকম হ’তে বলি। আমরা নিজেরাও কি ঠিকঠাক শিক্ষক হ’তে পেরেছি? পারি নি!’ নাহ্...
স্যারের ফেয়ারওয়েলে কে গান গাইল, আদৌ ফেয়ারওয়েল হয়েছে কি
না... সেসব কিছুই জানি না। তবে, মাঝে মাঝে আশিষ স্যারের কথা
মনে পড়ে। এমনিই মনে পড়ে... আর মাঝে মাঝে মনে পড়ে কোথাও রক্ত দেখলে। স্যার বলেছিলেন
– “একবার একটা মিনি বাসে করে যেতে যেতে বাসটার অ্যাক্সিডেন্ট
হ’ল... সামনের বাসটা হঠাৎ ব্রেক কষল আর মিনিবাসটা সোজা মেরে
দিলো বাসটাকে পেছন থেকে। মাথাটা সামনের সিটের লোহায় খুব জোরে ঠুকে গেল। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম জল! বোধহয় খুব
নার্ভাস হয়ে গেলে কিংবা শক পেলে এভাবেই রক্তের রঙ চেনা যায় না, মনে হয়
জল।“
আমি অনেকবার খেয়াল করেছি, রক্ত
দেখে বিবর্ণ জল মনে হয় কি না... কিন্তু কই, আমি তো লালই
দেখি... টকটকে লাল, গাঢ় লাল, কালচে
লাল। জলের মত আজও তো দেখলাম না? তাহলে হয়ত আমি স্যারের মত
নার্ভাস হই নি, কিংবা শক পাইনি সেরকম হঠাৎ করে।
আসলে কি
জানেন? স্যারেরা স্যারেদের মতন। আর যারা স্যারেদের মতন,
তারাই কিছু মিল টিল পাবে। আমি আর কই?! এই
ফিজিক্স ক্লাসেই কত জানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। উত্তরটা মনে মনে গুছিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করতাম বার বার। আর যত বার গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতাম হাতের ফাঁক
দিকে টুপটাপ কিছু না কিছু পড়ে যেত, আবার কুড়িয়ে নিতে নিতে...
ঠিক অন্য কেউ বলে দিতো। স্যার পার করে চলে যেতেন সেই বিষয়টা। দু’বার খুব চেষ্টা করেছিলাম... উঠে দাঁড়িয়ে। স্যার সবটা শুনে বললেন... বুঝতে
পারছি বুঝেছিস, কিন্তু আর একটু গুছিয়ে কেউ বলতে পারবে?
অন্য একজন দাঁড়িয়ে ঝাড়া মুখস্থ বলে দিল। আমার আর গুছিয়ে ওঠা হ’ল না। আজও এমন কত কিছু দেখি, মনে হয় বুঝতে পেরেছি...
কিন্তু গুছিয়ে বলতে হলে বুঝতে পারি, আমি না বললেই ভাল। সব
কিছু টপকে অনেকটা তাড়াহুড়ো থেকে যাবে, যার মানেটাই আলাদা।
এরা কেউ আশিষ স্যার নয়, এরা কেউই বুঝবে না, যে আমি বুঝতে পেরেছি। আর আমার চেষ্টার কথা? তার ধারে
কাছেও যারা কখনও কোনওদিন থাকে নি, তাকে এক ঝলক দেখেওনি
কখনও... তারাও হলফ করে বলে দিতে পারে, তার কোনও অস্তিত্বই
নেই! ‘কোনও চেষ্টা নেই’ এই কথাটা এত
বার এত জনকে বলতে শুনেছি, যে আর কোনও গুরুত্বই দিই না। অথচ
আমি জানি, চেষ্টা করেছিলাম। যে সবুজ রঙ করা জানলাটা কিছুতেই
ঠিক ভাবে বন্ধ হ’ত না... চেষ্টা করেছিলাম তার জন্য। প্রথমে
জানলার কব্জা, তারপর বেড়ে যাওয়া কাঠ... চেষ্টা করেছিলাম,
তাই একদিন ঠিক জানলাটা বন্ধ হ’ত, আবার খোলা যেত। জানলাটা দেখেছে সবাই। চেষ্টাগুলো কবজির জঙে মিশে গেছে
নারকোল তেল হয়ে।
ইস্কুলের বইতে একবার
একটা নাম দেখেছিলাম... আর ই এম বি আর এ এন ডি টি ... Rembrandt। উচ্চারণ
করেছিলাম রেম্ব্রান্ডট্। ওই ডি আর টি পাশাপাশি কেমন হয় কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। কেউ
বলে রেমব্রাঁ, কেউ বলল রেম্ব্রাণ্ড্ট্। এরপরে আরও কিছু শব্দ এলো পর পর… Renaissance, Entente, Mont Blanc। জানলাম, যা দেখছি তার
কোনওটাই আসলে তা নয়! তারপর চেষ্টা করেছিলাম
খাতার একটা লাইনে দশটার বেশি শব্দ লেখার... তারপর আরও বেশি, যাতে কম
পাতা খরচ হয়। কম খাতা কিনতে হয়। তারপর চেষ্টা করেছিলাম পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা
হেঁটে পাঁচ টাকা বাঁচানোর। একটা চেষ্টা করতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল,
মন থেকে... একজন কে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেওয়ার। হয়ত কেউ কোনওদিনও
আমার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতো না বলেই। এত কিছু করে কী হ’ল?
হাতের লেখাটা নষ্ট হ’ল। রোদের মধ্যে হাঁটতে
হাঁটতে গরমে শ্বাস কষ্ট বাঁধালাম। আর সারপ্রাইজের সেই লাল কলমটা অনেক দূর অবধি
সঙ্গে সঙ্গে গেছিল... কয়েকটা বছর সময় চাওয়ার বোকা বোকা চেষ্টা নিয়ে। তারপর আমার
সঙ্গেই ফিরে এলো। অনেকদিন থেকে গেছিল আলমারিতে, লাল মার্বেল
কাগজে লেখা কাঁপা কাঁপা লেখাগুলো নিয়েই। নিজেরও ব্যবহার করতে ইচ্ছে করত না... আর
ফেলে দিতেও ইচ্ছে করত না। তবে, সে সব অনেক বছর আগের কথা...
এখন সেই কলম দেখতে চাইলে দেখাতে পারব না। নিজেই জানি না কোন চুলোয় গেছে... অন্য
চেষ্টাগুলোর সাথে। চেষ্টাগুলোরও আর গুছিয়ে ওঠা হ’ল না।
শ্বশুরবাড়ির
লোকজন প্রথম দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক কথা বলত। এখন পুরনো হয়ে গেছি, সোজাসুজি বলে। বউও মেয়েকে মনে করিয়ে দেয়... বাবা বিশেষ কিছুই ব্যবস্থা করে
রাখছে না, পরে ভুগতে হবে। আমি ঘটি গড়িয়ে জল খাওয়ার কথা বলে
তর্ক করি না। দু বছর পর সব পালটে যাবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিই না। আর ঠিক কী বললে
ভাল, তাও বুঝতে পারি না। কি বলে আশ্বস্ত করা যায়, ভাবতে ভাবতেই ঘুম পেয়ে যায়... তারপর আর একটা সকাল। ছোটবেলায় এত বার বলার পরেও
সাইকেল চালানো শিখিনি। আর শ্বশুরমশাই এত বার বলার পরেও কোনও রক্ত প্রবাল কিংবা
গোমেদ, কিছুই হাতে ওঠেনি। কলেজের বামপন্থী বন্ধুরা এতবার
বলার পরেও গায়ে পৈতে রাখা বন্ধ করিনি। কালীমন্দিরেও যেতাম মাঝে মাঝে। তাই আমার মত
বুর্জোয়াদের দিয়ে কোনও কাজ হবে না সেকথা অনেকবার শুনেছি। কয়েকবার ভোটের সময় মিছিলে
হাঁটা ছাড়া আর কোনও কাজ হয়েও নি আমাকে দিয়ে। অবশ্য পার্টির জন্য চাঁদা নেওয়ার কথা
আলাদা। আসলে আমি বামপন্থী, না বুর্জোয়া, আস্তিক না নাস্তিক... এ সব প্রমান করার বা সপক্ষে কোনও যুক্তি দেওয়ার
প্রয়োজনই মনে করিনি কখনও। আমি যা-ই হই, তাতে কি কিছু পালটে
যেতো কখনও? আস্তিকদের ভোট আর টাকায় কোনও আপত্তি নেই, তাহলেই হ’ল। ঠিক যেমন – কে কোন
রঙের আবির উড়োচ্ছে, সেটা বড় কথা নয়। কোন না কোন রঙ উড়বেই,
আর ওড়ানোর লোকও ঠিক জুটে যায়। এদিকে অফিসের ইউনিয়ন যখন মাসের শুরুতে
রসিদ কেটে টাকা নিয়ে যেতো, তাদের বলেছিলাম – “আমি আস্তিক বুর্জোয়া, কমিউনিস্টও নই... তাহলে?”
তাহলে অনেক কিছুই... কিন্তু তাতে টাকা দেওয়ার নিয়ম পালটাল না। পাড়ার
এক সম্মানিত দাদা একবার বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন কীভাবে একজন কমিউনিস্ট আস্তিক হ’তে পারেও, আর কীভাবে একজন আস্তিকও কমিউনিস্ট হ’তে পারে। না... আমাকে ওনার বিশেষ কোনও দরকার ছিল না, তাই আমার মগজ ধোলাইয়ে চেষ্টা উনি করেন নি। উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। বিদেশী
পণ্ডিৎ ব্যক্তিদের নাম, তাঁদের কথা... এসব বলছিলেন। কী
বলছিলেন, ভাল মনে নেই। তবে, আবার যখন
জিজ্ঞেস করলাম – ‘তাহ’লে ঠাকুর-দেবতা
মানি বলে আমাকে বুর্জোয়া কেন বলত?’ বললেন – ‘ওরা ছেলেমানুষ। ওদের কথা বাদ দাও!’ আমি আর বাদ দিই কি করে?
আমাকেই তো বাদ দিয়ে দিলো! জানতে ইচ্ছে হয়েছিল... “দেশ জুড়ে এত এত ছেলেমানুষ কমিউনিস্ট ছড়িয়ে গেছে?!
এদের সামলাবেন কি করে?” তবে ওনাকে আর এসব বলে বিরক্ত করি নি।
এমনিতেই মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা লোকজন দেখলে কেমন লাগে! এঞ্জেল, না এঙ্গেল, না অ্যাঙ্গেল, না
অ্যাঞ্জেল... এই নিয়ে আমার এখনও যথেষ্ট গোলমাল হয়। আমার মা কালী বাড়ি যাওয়া,
আংটি পরতে না চাওয়া, শাশুড়ির গুরুদেবকে প্রণাম
না করা... এইসব কিছু নিয়েই আমার ভোটার আই ডি কার্ড। কি মন্দিরে, কি ভোটের দিন, কি
সরকারী কোনও ফর্ম তুলতে... লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই থাকি, দাঁড়িয়েই
থাকি...
ঘর
অন্ধকার, ঘড়ি দেখতে না পেলেও টিকটিক শুনতে পাই। রাত কত,
বুঝতে না পারলেও... বুঝতে পারি সে গভীর। মশারির ফুটো দিয়ে মশা ভেতরে
ঢোকে, কিন্তু কেউ সেই ফুটো দিয়ে কি বাইরে বেরোতে চায় আর?
অন্ধকারেই কানের কাছে ঘুরবে, অথচ কানের ধারে
কাছে না এসে পায়ে বসে নিশ্চিন্তে ভর পেট্টা রক্ত খেয়ে গেলে কেউ কিচ্ছুটি বুঝতে
পারত না ঘুমের ঘোরে। সেই কানের কাছেই উড়বে... যুদ্ধের ভোঁ শুনে আমি জেগে থাকব আর
একের পর এক পাতা উলটে যাব... যতক্ষণ না ঘুম আসে, অথবা
আন্দাজে মারা চাপড়ে একটা মশা থেঁতলে যায়। অন্ধকারে রক্ত দেখা যায় না।
তবু সে রক্ত, তবু সে বিষ, তবু সে
শুকিয়ে কালো হয়। আমি যে এত কথা বলি, ভাবতে গেলে অনেক...
কিন্তু এতগুলো কথা আসে খুব তাড়াতাড়ি, আর এসেই চলে যায়। একজের
পর একজন, ঢেউয়ের মত। ঢেউ গুণতে গুণতে রোজ ঘুমিয়ে পড়ি। আমি
বলি, আর আমিই শুনি। এতক্ষন যে এতকিছু শুনলেন... তা কি আপনাকে
ডেকে শোনালাম? নাহ্... আপনিও আমার কাছে একটা দেওয়ালই। যে
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনায়াসে লোডশেডিং-এর রাত কাটিয়ে দেওয়া যায় কাঁপা
কাঁপা মোমবাতির আলোয়। যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বৃষ্টির রাতেও জমিয়ে আড্ডা চলে
কার্নিশের নিচে। দেওয়ালের যত কাছে পিঠ, গায়ে ছাঁট লাগার
সম্ভাবনা ততটা কম। অথবা, আপনি আমার কাছে সেই ছাত, মশারির ওপারে সিলিং ফ্যান ঝুলিয়ে রাখার জন্য যেটা খুবই দরকার, যেটা না থাকলে আমার চলত না, সে যতই প্লাস্টার খসে
পড়ুক না কেন! অথচ আপনি না
শুনলেও আমার কথাগুলো ভেতর ভেতর চলতেই থাকবে... কারখানার কলের মত। ওই একটা জায়গাতেই
আমি চিৎকার করে কাউকে বলতে পারি খানকির ছেলে! আমার ছোঁড়া আধলা ইটগুলো অনেক দূর
অবধি গিয়ে কারও গাড়ির কাঁচ, অথবা কোনও দোতলা বাড়ির জানলার ওপর আছড়ে
পরে! নিজেই ইচ্ছে মত হয়ে উঠি হ্যাণ্ড গ্রেনেড, অথবা মলোটভ
ককটেল। কথার পর কথা সাজিয়ে বলতে পারি... কিরে! এখন মুখে রা সরছে না কেন? বল কি বলবি? আছে কোনও জবাব?
পনেরো
বছর পার করে দিয়েও ঘুমের ঘোরে যে মানুষটার হাতে এগিয়ে এগিয়ে আমাকে খোঁজার চেষ্টা
করে, এখন তার নাগালের বাইরেই সেই দু’টো নৌকোর কথা ভাবব,
যাদের দেখেছিলাম ভেরির ধারে বাঁশের সাঁকোর কাছে। ভীষণ বৃষ্টি পড়লে
নৌকোর ভেতর জল জমে অমন ডুবু ডুবু কেন হ’ত? সেই ঘুমন্ত হাতের দুটো আঙুলের একটা ছুঁলেই উত্তর - অক্টোবর না নভেম্বর...
কোন মাসে বিপ্লব জন্মালে বেশি দীর্ঘজীবী হয়? যদি কিছুটা জমি থাকে
আমাদের এখনও তৈরী না হওয়া বাড়িটার সামনে... তাতে কোন কোন ফুলের গাছ লাগালে ভাল হয়? মনের করার চেষ্টা করব সেই ফুলের নামগুলো... যেগুলো ওর প্রিয় ফুল বলে
চিনিয়েছিল আমাকে, যখন ওদের বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। খুব
রাগে যখন কান লাল হয়ে যায়, তখন দেখেছি... ভরা বর্ষায় দুলতে
থাকা নৌকা জোড়া, অথবা বাগানের সেই ফুলগাছ,
অথবা নিম গাছের ছায়ার কথা ভাবলে আসতে আসতে আবার সব কিছু কেমন ঠাণ্ডা
হয়ে আসে! আজ বৃষ্টি পড়ছে বলে শ্রাবণ মাসে সেই ভেরির জলে ছোট ছোট ঢেউগুলোর কথা বেশি
মনে পড়ছে। কলেজের প্র্যাক্টিকাল খাতা ভিজে যাওয়ার চিন্তা আজ আর নেই... শুধু
ঢেউগুলো রয়ে গেছে, আর ভিজে বাতাস। মশারির ভেতরেও আর একটা মশা
নেই। সব চলে গেছে, রক্তের দাগ দিয়ে। আমিও ঘুমবো... আর একটু
পরে, ভোর চারটে বাজার পর। ওহ্! আপনাকে জানানো হয়নি... তিনটে
থেকে চারটে, এই একঘণ্টা আমার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসি... কখনও
মশারির বাইরে, কখনও ঘরের বাইরে। এখন আমি ছাতের কাছাকাছি...
দেখুন মশারির ভেতরে কেমন যুদ্ধ বিরতি চলছে। তিনজনের গায়েই কম বেশি লাল ফোলা ফোলা
দাগ... অথবা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিঠে দেখতে পাবেন... দেখুন, এই অন্ধকারেই বেশি বোঝা যায়। ভোরের আলো ফুটলেই সেই আলোয় সব মিশে যাবে,
তখন আর কিচ্ছুটি খুঁজে পাবেন না!
চাবুক লেখা। দারুণ লেগেছে।
ReplyDelete