সম্পাদকীয়



একটা সময় ছিল, কিছু উন্নাসিক লোক বলতেন নাটকই হল আসল মাধ্যম যেখানে অভিনয়শিল্পের চরমটা দেখা যায়, আর সিনেমা নাকি একটা ফাঁকিবাজ আর গ্ল্যামারসর্বস্ব জায়গা, অভিনেতারা সেখানে ধান্দাবাজ পরিচালকদের হাতের পুতুল। আজ সেই কথা কি কেউ বলেন? অবিশ্যি আজও কিছু লোক আছেন, যারা বলেন কাগুজে পত্রিকাই হল আসল, ব্লগজিন বা ওয়েবজিনগুলোকে ঠিক পত্রিকা বলা চলে না, ওগুলো ছেলেখেলার ব্যাপার।
ছেলেখেলা বুঝি খুব সস্তা ব্যাপার? একবার খেলে দেখান না মশাইরা!
প্রিয় পাঠক, আশা করি আপনি ব্যাটম্যানের নাম শুনেছেন, ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমাগুলোও নিশ্চয়ই দেখেছেন? সেই যে জোকার জিজ্ঞেস করেছিল, “হোয়াই সো সিরিয়াস?????” সেই জিজ্ঞাসা তো আমারও। কবিতা কী, যে তার জন্য আপনি অত গম্ভীর হয়ে আছেন? কবিতা পত্রিকা কি কেউ রাষ্ট্রকে দিশা দেওয়ার জন্য করে, নাকি সমাজকে বদলে ফেলতে পারে একটা কবিতাপত্রিকা? কিছুই তো পারে না সে।
ঘন শালবন চিরে বেরিয়ে যাওয়া লাল মোরামের রাস্তা। তার ধারে অশ্বত্থ গাছ। প্রখর রোদ। লাল মাটি আগুন হয়ে আছে। আপনি বাইক থামালেন, লুকিং গ্লাসে হেলমেটটা ঝুলিয়ে দিলেনগাছটিতে ঠেস দিয়ে বসলেন। অশ্বত্থের ঠাণ্ডা ছায়া আপনাকে জুড়িয়ে দিল। বাইকের সাইলেন্সার থেকে মৃদু আওয়াজ আসছে, যন্ত্রটি ঠান্ডা হচ্ছেআপনার ঘাম শুকিয়ে এল, চোখ মুদে এল। গাছের বিরাট ছায়াটি ঘিরে যে কাঁকরে ভরা জমি, তার প্রচণ্ড উত্তাপ, আর অরণ্যের বাষ্পীয় হাওয়া তার দাপট নিয়ে আপনাকে স্পর্শ করছে বটে, কিন্তু এই মহাদ্রুমের শীতল ছায়া আপনাকে ঘিরেছে। একটা ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া সব নিশ্চুপ। মাথার উপর একটা আকাশ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, কোটি কোটি বছর ধরে তার রং ঠিক অমনই অসম্ভব নীল। ওখানে আপনি আধঘন্টা বসুনএকটা সমগ্র জীবন, ওই আধঘন্টায় কেটে যাবে।
ওই তো কবিতা। ওই মন নিয়ে বসাটাই কবিতা। ওই বসা নিয়ে লিখুন, তাতে চর্বি আর ক্লেদ জমতে চাইবে, সেটাকে সাফ করতে হলে নির্মম হতে হবে। বানানো চলবে না। প্লাস্টিকের অশ্বত্থ গাছ হয় না, পলিথিন দিয়ে ছায়া বানানো যায় না। তাই...
কবিতা নিয়ে অত সিরিয়াস কেন হচ্ছেন? বরং দেবতা হয়ে যান। একমাত্র কোনোকিছু নষ্ট করে ফ্যালা ছাড়া, মানুষ যা কিছুই মনপ্রাণ দিয়ে করে, করতে চায়, সেখানে সে দেবতা হয়ে ওঠে। বেপরোয়া দেবতা হয়ে ওঠে।
              যেমন বব ডিলান। উনি সদ্য নোবেল পাওয়ার পরে কিছু বাঙালি কোবির প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে যেন রঞ্জিৎ মল্লিক অস্কার পেয়ে গেছেন। কেউ কেউ এত রেগে গেছেন মনে হচ্ছে প্রাইজটা তাঁরই পাওয়ার ছিল, ওই টাকাতেই দেওয়ালির মার্কেটিং করতেন, ডিলান কাঠি করে ঝেড়ে দিলেন। কেউ আবার উচ্ছ্বসিত, তিনি ভেবেছেন রক মিউজিকের জয় হল। আরে বাবা ডিলানের সঙ্গে মাটির যোগ, লোকসংস্কৃতির যোগ, রকবাজিতে উনি নেই। প্লিজ, উনি রূপম ইসলাম নন, বরং ওঁকে লালন ফকির বা রামপ্রসাদের সঙ্গে মিলিয়ে ভাবুন। মুশকিল হল, এই প্রথম কেউ সাহিত্যে নোবেল পেল, যার নামটা এঁরা আগে শুনেছেন, প্রাইজ পাওয়ার পরে গুগল বা উইকিপিডিয়া ঘাঁটতে হয়নি। নিজেদের গাঢ় সাহিত্যবোধ নিয়ে নিজেদের আয়নার সামনে এই যে এঁরা বোকা হয়ে গেলেন, এই খেলাটাই কিন্তু বব ডিলানের খুব প্রিয়, তাই না?
এই সংখ্যা থেকে ‘বাক্’ কয়েকমাস পাক্ষিক রূপে প্রকাশিত হবে, যাতে আপনি আরো বেশি কবিতা লিখতে পারেন, আর কোবিদের চেয়ে আলাদা হতে পারেন।
অত সিরিয়াস কেন হচ্ছেন?
জয়স্তু।
                           অনুপম মুখোপাধ্যায়।। অক্টোবর।। ২০১৬।। ঘাটাল